ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক—এ ধরনের
জীবাণুর নাম শুনলেই কেমন একটা
নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সবার মনে। তবে
বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় এই ধারণার পরিবর্তন
হচ্ছে অনেক আগ থেকেই। সব জীবাণু যে
অমাদের জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং এর থেকে
আবিষ্কার হয়েছে জীবন রক্ষাকারী
পেনিসিলিনের মতো বিস্ময়কর ওষুধ। তবে এ
সবই সম্ভব হয়েছে অণুজীববিজ্ঞানীদের
কল্যাণে। এই ছোট ছোট জীব নিয়ে
গবেষণার মাধ্যমে পড়তে পারেন
মাইক্রোবায়োলজি বা (অণুজীববিজ্ঞান)।
আর হতে পারেন অণুজীববিজ্ঞানী।
অণুজীববিজ্ঞান: মাইক্রোবায়োলজি গ্রিক
শব্দ মিকরস (Mikros) মানে অণু, বায়োজ
(Bios) মানে জীবন এবং লজিয়া (Logia)
মানে জ্ঞান থেকে এসেছে। এ বিষয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক
সিরাজুল ইসলাম খান বলেন, অণুজীব
একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককোষী জীব, যা
অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে দেখা
যায় না। যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া,
ছত্রাক ইত্যাদি। এক কথায় বিজ্ঞানের যে
শাখা জীবাণু ও অণুজীব নিয়ে কাজ করে,
তাকেই অণুজীববিজ্ঞান বলে। তিনি আরও
বলেন, জীবাণুর চরিত্র, বংশবিস্তারের
পদ্ধতি, দুষ্ট ও ক্ষতিকর জীবাণু থেকে
বাঁচার উপায়, উপকারিতা—এই বিষয়গুলোই
হচ্ছে মাইক্রোবায়োলজির নিরন্তর
গবেষণার বিষয়।
যেভাবে শুরু: সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন,
লুই পাস্তুর হলেন অণুজীববিজ্ঞানের জনক।
কিন্তু এন্টনি ফন লিভেনহুক প্রথম ব্যক্তি,
যিনি ১৬৭৬ সালে পর্যবেক্ষণ করেন
ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু। এতে
ব্যবহার করেন নিজের তৈরি একক লেন্সের
একটি অণুবীক্ষণযন্ত্র। ১৮০০ সালের শুরুর
দিকে লুই পাস্তুর ও রবার্ট কর্ক প্রমাণ
করেন, জীবাণুও একধরনের জীব। তাঁদের এই
পর্যবেক্ষণ থেকে উদ্ভব হয় এক নবদিগন্ত, তা
হলো মাইক্রোবায়োলজি। ১৯৭৫ সালে
চিকিৎসক এম আর চৌধুরীর নেতৃত্বে ১২-১৫
জন সদস্য নিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব
মাইক্রোবায়োলজিস্ট (বিএসএম) নামক
একটি সোসাইটির মাধ্যমে প্রথম
অণুজীববিজ্ঞানের কার্যক্রম শুরু হয়
বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু
হয় ১৯৭৯ সালে মাস্টার্স কোর্সের মাধ্যমে।
গুরুত্ব: অণুজীব ভূপৃষ্ঠ, বাতাস, এমনকি
লবণাক্ত পানিতেও বাঁচতে পারে। সব
প্রাণীর দেহে এর অস্তিত্ব আছে। তবে
মজার ব্যাপার হলো, মানুষের দেহে
কোষের তুলনায় অণুজীবের সংখ্যা ও
পরিমাণ বেশি। অধ্যাপক বলেন, অণুজীব
সর্ম্পকে ভুল ধারণা হলো, অধিকাংশ
জীবাণুই আমাদের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু
মাত্র ১ শতাংশেরও কম বাদে, বাকি
অণুজীব আমাদের দেহের রোগব্যধির
পরিবর্তে উপকারই বেশি করে। যেমন
ব্যাকটেরিয়া মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি
করে গাছপালা ও শস্য উৎপাদনে সাহায্য
করে। গাছের শিকড়ে থাকা অণুজীব মৃত
প্রাণীকে পচিয়ে গাছের খাদ্য তৈরি করে।
ছত্রাক রুটিকে ফুলিয়ে বিস্তৃত করতে
সাহায্য করে। ছত্রাক ও ব্যকটেরিয়া দিয়ে
সংক্রমণ প্রতিষেধক অত্যন্ত শক্তিশালী
ওষুধ পেনিসিলিন ও টেট্রাসাইক্লিন তৈরি
হয়। এই ওষুধ গলাব্যথা, কানব্যথা, উদরাময় ও
অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ধ্বংস
করে শরীরকে সুস্থ রাখে।
পড়তে হলে: অণুজীববিজ্ঞান বিষয়টি
বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি
স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে পড়তে ‘ক’
ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটিতে বিজ্ঞান
বিভাগে (চতুর্থ বিষয় বাদে) মোট জিপিএ
৮.০০ থাকতে হবে। বললেন অধ্যাপক এস অই
খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রায়
সব পাবলিক এবং কয়েকটি বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে
পড়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তিতে ভর্তি যোগ্যতার ভিন্নতা
রয়েছে। এ ছাড়া হেলথ টেকনিক্যাল
ডিপ্লোমা করেও এ বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে
পড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি
সরকারি ও বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ
বিষয়ে পড়ার সুয়োগ আছে।
যা পড়ানো হয়: এ বিষয়ে স্নাতক ও
স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে মূলত ভাইরাস,
ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক সম্পর্কে বিশদ
পড়ানো হয়। এ ছাড়া জেনারেল
মাইক্রোবায়োলজি, বেসিক টেকনিক অব
মাইক্রোবায়োলজি, বেসিক
বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবিয়াল
ইকোলজি, বেসিক মাইক্রোবিয়াল
জেনেটিক্স, ইমুনোলজি, এনজাইমোলজি,
এনভায়রনমেন্টাল, ফুড, মেডিকেল, সয়েল,
এগ্রিকালচারাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল,
ফার্মাসিউটিক্যালস, ক্লিনিক অ্যান্ড
ডায়াগনস্টিক, জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং,
এনালিটিক্যাল, মাইক্রোবিয়াল,
ব্যাকটেরিয়লজি, কোয়ালিটি কন্ট্রল অব
ফুড, ফিশ অ্যান্ড বেভারেজ ইত্যাদি বিষয়
পড়তে হয়। বললেন অধ্যাপক এস আই খান।
কাজের ক্ষেত্র: কাজের সুযোগ প্রসঙ্গে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান
বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র মো.
আশরাফ বলেন, ২০৫০ সালে পৃথিবীর
জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট
বেড়ে যাবে। এতে ফসলি জমি কমে যাবে।
খাদ্যের ঘাটতি ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে
থাকবে। তখন খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষা করতে আমাদের নির্ভর
করতে হবে অণুজীববিজ্ঞান ও
বায়োটেকনোলজির ওপর। তাই প্রতিনিয়তই
চাহিদা বাড়ছে এ বিষয়ে পড়ার।
এ বিষয়ে পড়ে হতে পারেন সাইনটিস্ট,
মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, বিজনেস
ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ, প্রোডাক্ট
স্পেশালিস্ট, ডায়াগনস্টিক স্পেশালিস্ট,
মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ, গবেষক ও
শিক্ষক। এসব পদে আইসিডিডিআরবি
হাসপাতাল ও বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক
সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান,
ভেকসিন প্রোগ্রাম, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক
প্রকল্প, খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুতকারী
প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, বায়ো
ইন্ডাস্ট্রি, পেপার ইন্ডাস্ট্রি, টেক্সটাইল
মিল, পরমাণু শক্তি কমিশন, পাট গবেষণা
কেন্দ্র, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি ও পরিবেশ
ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে
কাজের ব্যাপক সুযোগ।
এস আই খান বলেন, যাঁরা এসব বিষয়ে ভালো
করতে চান, তাঁদের থাকতে হবে গবেষণার
মনোবৃত্তি। তাহলে খুব সহজেই পৌঁছে
যাবেন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে।
Comments
Post a Comment